একটি পুকুর, যেমন পরিষ্কার তেমন স্বচ্ছ তার জল, যার নেই কোন রং। পাড়টি সুন্দর করে বাঁধানো। পাড়ের ধারের গাছগুলি থেকে ঝড়ে পড়া পাতায় পুকুরের জলে ভেসে চলে কত ছোট ছোট নৌকা। তার উপর বাতাসের হালকা দোলাতে জলে ওঠে ঢেও তরঙ্গ। মাঝে মাঝে দেখা যায় পথিক এসে বসেছে পুকুরের ধারে। কত কুসুম ফুল ফুটে উঠেছে পুকুরের ধারে লাগানো অজানা বিদেশী গাছগুলিতে।
এইভাবে প্রকৃতির বুকে ঐ পুকুরটি তার নিজের পরিচয় পেয়েছে, রোজ কত নতুন অজানা পাখি তাদের তৃষ্ণা মিটিয়ে উড়ে চলে দূর কোন ঠিকানায়। প্রতি বছর বিভিন্ন ঋতু আসে আর অজান্তেই চলে যায়। কখনও কাট ফাটা দুপুরের রোদে ফুটন্ত অবস্থাতে বা কখনও শিতের স্নিগ্ধ সকালকে গায়ে মেখে। বর্ষায় যতই বৃষ্টি হোক কখনও দুকুল ছাপিয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা হয়নি।
আজ এক এক অদ্ভুত কাহিনী শোনায় তবে এই পুকুরের। এই কয়েক বছর আগের কথা। তখন পুকুরটি এতটা সুন্দর না থাকলেও যথেষ্ট ভালো দেখতে ছিল। পুকুরের পারে ঐ যে দক্ষিন দিক ঠিক ওখানেই একটা শিমুল গাছ ছিল, আর তার ঠিক নিচেতে ব্রিটিশ আমলের দেখতে একটি লম্বা চেয়ার ছিল। একদিন হঠাৎ একটি মেয়ে (বছর উনিশের হবে হইত) এসে বসে পুকুরের দিকে মুখ করে রাখা ঐ চেয়ারে। শিমুল ফুলের মিষ্টি গন্ধে তার বিকেল কাটে ঐ চেয়ারে বসেই। এক অদ্ভুত দৃষ্টিতে চেয়ে থাকত সামনে পুকুরের দিকে, মন ভরে গেলে চলে যেত।
এইভাবে চলছিল ঠিকই, তারপর কয়েকদিন আর তার দেখা নেই। সে কি অন্য পথিকদের মতো হারিয়ে গেল, না –সে যা এতদিন খুঁজছিল সেটা পেয়ে গেল।— আর দেখা পাওয়া গেল না তার। সবই তো ঠিক ছিল। রোজ তার ঐ অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকা কেন জানিনা মিশে গিয়েছিল বিকালের সাথে।
এইভাবে কেটে গেল কত ঋতু, এল ফাল্গুন মাস দোলের বার্তা নিয়ে। একদিন হঠাৎ দুপুরে সেই মেয়েটির দেখা। আজ তার মুখে নেই সেই আগের চাহনি—আজ সে অনেক পরিবর্তিত, বরং রয়েছে অজস্র উৎসাহের আবছায়া। হ্যাঁ, আজ সে নেই একা পাশে তার সাথে রয়েছে একটি যুবক (বয়স আন্দাজ একুশ হবে)। হইত সে তার রঙ্গেই আজ সে রঙ্গিন। দুজনেই ব্যাস্ত রং মাখাতে ও আবির ছড়াতে। আজ মেয়েটিকে দেখে পুকুরটিও খুব আনন্দিত। আজ কি মনে হল পুকুরেরও রং মাখার সখ হল। তাদের ঐ আনন্দের মধ্যে নিজেকেও রঙিন করার খুব বাসনা।
একি ওরাও মনের কথা বুঝতে পেরেছে মনে হয়—দেখি দুজনে তাদের বাকিটুকু রং ছড়িয়ে দিয়েছে আসে পাশে থাকা গাছের পাতায় পাতায়, কিছুটা জলেতেও পরেছে। জলের রং হয়েছে লাল, নীল, সবুজ, কমলা। রামধনুর মত করে আজ সেজে উঠেছে পুকুরের জল। কতক পড়ে দুজনেই ঐ দিনের খুশি ছড়িয়ে চলে যায়। এদিকে গাছের ফুলগুলি তখন নতুন রং পেয়ে খুব খুশি। তাদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে পুকুরে জলও নিজেকে সাজিয়েছে। সবাই আজ সুসজ্জিত। প্রকৃতি আজ পূর্ণ ঐ প্রেমিক প্রেমিকার আগমনে। হ্যাঁ দুজনকে খুব মানিয়েছে। এই আনন্দ তাদের বহু দিনের সঞ্চয় হয়ে থাকবে কোনদিন ভুলতে পারবেনা।
তারপর কেটে গেল গোটা একটি বছর, ফিরে এলো সেই স্মৃতি ঘেরা বিকেল বেলা। আর সেই যুগলের দেখা পাওয়া যায়নি। এখন পুকুরে জলে মিশেছে বছরের জমা স্মৃতি। আর সেই পুকুর নেই যার তীরে বসে কখনও কোনও পথিক তার দুপুরের ক্লান্তি মিটিয়েছিল। পাখিরা তাদের পথের তৃষ্ণা মিটিয়েছিল। নেই প্রতিদিনের সুন্দর সকাল, বিকেল। পড়ে আছে শুধুই স্মৃতি। আর জমেছে তলদেশে কত পচা পাতা, থাক থাক শেওলা, গজিয়েছে কত অজানা গাছ—আর অজানা ফুলের সংখ্যায় ভড়েছে পার। আজ পুকুর নিজেকে চিনতে পারে না। বছরের সমস্তটাই সে নিজেকে ভড়িয়েই গেছে, কখনও নিজের দিকে তাকানোর প্রয়োজন মনে করেনি। ওদিকে এখন আর সেই বসার চেয়ারটি আগের মতন নেই, গেল ঝড়ে শিমুল গাছের ডাল পড়ে একটি হাতল গেছে ভেঙ্গে। নিচু হয়ে কোন রকমে দাঁড়িয়ে আছে—চেয়ে আছে পুকুরের পানে। দুপুর তবু হালকা অন্ধকার হয়ে এসেছে। একি আজ কে ঐ চেয়ারে বসে। হ্যাঁ সেই মেয়েটিই তো—সেই আগের মত এক জায়গায় বসে সেই আগের মত চোখের দৃষ্টি। অবাক দৃষ্টিতে আবার সেই পুকুরের দিকে চেয়ে। আজ সেই দৃষ্টিতে নেই ফাগুনের রং, নেই প্রফুল্লতা। বরং চোখের কোনে জমেছে কালি। আজ সে দুটি চোখে লাল আভা প্রস্ফুটিত। সে চোখ কিছু বলতে চায়ছে, আজ তার নেই কোনও বাঁধা। আগেও বলতে চেয়েছিল কিন্তু দায়িত্ব তাকে বলতে দিতে পারিনি। কতবার ভেবেছিল তবু ঠোঁটে মুখে তা প্রকাশ করতে দেয়নি। যেন আজ সে সব বলতে চায় মন উজার করে। আজ পুকুরও যেন ফুলে ফেঁপে উঠেছে, খুব আগ্রহী শোনার জন্য। আজ দুজনে বহু দিনের পর আবার একত্রিত। মেয়েটিও চায়ছে নিজেকে উজাড় করে দিতে, সঁপে দিতে তার সব ব্যাথা বেদনা। দুজনেই ব্যাস্ত হয়ে পড়েছে তাদের জমানো কথা জানানোর জন্য।—
হ্যাঁ, তাই হল—আজ সব কথা একে অপরকে জানিয়ে দিল। পুকুরে দীর্ঘ বছর ধরে জমে থাকা অন্ধ কোনের দরজা খুলে দিল। ক্রমশ মেঘ ঘনিয়ে এসেছে সে কেও বুঝতেও পারিনি, পশ্চিমের ঝোড়ো হাওয়া নিয়ে এসেছে মুসল ধারে বৃষ্টি—তার সাথে মিসেছে মেঘের গর্জন। কখন যে দুজনে ধিরে ধিরে একে অন্যের কাছাকাছি চলে এসেছে বুঝতে পারিনি। বৃষ্টি ভেজা হিমেল রাতে কখন যে সব শেষ হয়ে গেছে, ঘুমিয়ে পড়েছে চিরতরে তা কেও জানতেই পারিনি।
সকাল হয়েছে প্রতিদিনের মতো না হলেও সূর্যের প্রথম আলো এসে পড়েছে শিমুল গাছের কচি পাতায়। সকালের পথে আজ কত নতুন মুখের প্রকাশ। আজ এক অদ্ভুত সকাল—সবার পথ যেন এসে মিশেছে এই পুকুরের পারে। আরও অদ্ভুত হচ্ছে তাদের সবারই দৃষ্টি পুকুরের দিকে। তাদের চোখের দৃষ্টিতে বহু প্রশ্নের চিহ্ন। আর হবেই না কেন—রাস্তায় চারিদিক আজ জলে থই থই। এদিকে পুকুরের জল অদ্ভুত ভাবে পার থেকে স্বাভাবিকের থেকে নিচুতে, যেন পুকুরের সব জল উঠে এসেছে রাস্তাতে। আগের দিন বিকেল অবধি দেখা গেছিলো পার ছাপানো জল, উপরন্তু রাতের বৃষ্টিতে যার ভেসে যাওয়ার কথা এবং পুকুর আর রাস্তার জলের উচ্চতা সমান হওয়াটা স্বাভাবিক। সেখানে এমন অদ্ভুত ঘটনার সাক্ষী হয়ে রইল সবাই। আর তার সাথে রেখে গেল কতকগুলি জিজ্ঞাসা। ঝড় ওইদিন রাতেও হল। এইরকম ঝড় কেও আগে শোনেনি বা দেখিওনি। বাড়ির বাইরে দৃষ্টি রাখা তো দূর ঘুমিয়েও কারর শান্তি নেই। যেমন ঝড় তেমন বৃষ্টি ও মেঘের গর্জন।
ভোরের দিকে হইতো শান্ত হয়েছিল, কখন যে ঘুমিয়ে পরেছি জানি না। সকালে চারিদিক ঝলমল করছে রোদ। জেগে উঠেছে নতুন অঙ্কুর নরম মাটি ভেদ করে। ওদিকে পুকুরেও আজ সেই একই দৃশ্য, শুধু নতুন বলতে শিমুল গাছটি আর নেই। তার বড় ডালটি সম্পূর্ণ ভেঙ্গে পড়েছে বসার চেয়ারের ওপর। কাওকে আর চেনা যাচ্ছে না।
বহুদিন পড়ে শুরু হয়েছে পরিষ্কার করে পুকুরটিকে সাজানো। আবার সেই চেনা রূপে ফিরিয়ে আনতে পৌরসভা থেকে শ্রমিক কাজে লেগেছে। আবার সবাই পুকুরটিকে ফিরে পাবে আগের মতন করে। নতুন ভাবে সেজে উঠবে আবার সেই বাঁধানো পুকুর পারে নতুন পথিক পাওয়ার আশায়। আর চাপা পড়ে থাকবে কিছু অজানা প্রশ্ন কিছু অজানা উত্তর, যা একমাত্র পুকুরই আগলে রাখবে শেষ অবধি।।—মানিক
Read it at Pratilipi: Click here